কোরিয়া যুদ্ধকে স্নায়ু যুদ্ধের প্রথম আগুন বলা হয়ে থাকে

উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যকার তিন বছরের অধিক (১৯৫০-৫৩) সময়ে সংঘটিত হওয়া একটি আঞ্চলিক সামরিক যুদ্ধ ইতিহাসে কোরীয় যুদ্ধ নামে পরিচিত। উত্তর কোরিয়ার পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে জাতিসংঘের সম্মতিতে আমেরিকা ও অন্য কয়েকটি দেশ এ যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহন করে।

কোরিয়া যুদ্ধকে স্নায়ু যুদ্ধের প্রথম আগুন বলা হয়ে থাকে

কোরীয় যুদ্ধে উভয় পক্ষই বিদেশী শক্তির সমর্থন পেয়েছিল


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে সংঘটিত হওয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় যুদ্ধ নিয়ে বিজয়ী মিত্রশক্তির মধ্যকার একটি চুক্তিকে কেন্দ্র করে কোরীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন এই যুদ্ধের প্রাথমিক কারন ধরা হয়। ১৯১০ সাল থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত জাপান সাম্রাজ্য কোরীয় উপদ্বীপ শাসন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আত্মসমর্পনের পর মার্কিন বাহিনী দক্ষিণ অর্ধেক এবং সোভিয়েত বাহিনী উত্তর অর্ধেক অধিকারে আনে।

কোরীয় উপদ্বীপের উত্তরে প্রতিষ্ঠিত হয় সাম্যবাদী সরকার আর দক্ষিণে প্রতিষ্ঠিত হয় মার্কিন সহায়তায় ডানপন্থী সরকার। একটি সামন্তরাল রেখা ক্রমেই দুই কোরীয় রাষ্ট্রের মধ্যে রাজনৈতিক ভাগ সৃষ্টি করে। ধীরে ধীরে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। বিচ্ছিন্ন লড়াই সংঘটিত হতে থাকে এবং পরিস্থিতি রণাঙ্গণে পরিণত হয়। উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়া আক্রমণ করে।

জাতিসংঘের অনুমোদন নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে আন্তর্জাতিক তিন লাখের মত সৈন্যের ৮৮ শতাংই মার্কিনিরা প্রদান করে। এরই মধ্যে উত্তর কোরিয়ার পক্ষে লড়াই করার জন্য চীন যুদ্ধে প্রবেশ করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন সরাসরি যুদ্ধে না জড়িয়ে যুদ্ধ সরজ্ঞাম দিয়ে সহায়তা করে। অনুমান করা হয় এ যুদ্ধে ২৫ লাখের বেশি বেসামরিক মানুষ হতাহত হয়েছে।

কোরীয় যুদ্ধে উভয় পক্ষই বিদেশী শক্তির সমর্থন পেয়েছিল। এটি ছিল স্নায়ু যুদ্ধের প্রথম দিকের একটি প্রধান ঘটনা, যা কোরীয় উপদ্বীপে দুই বিপরীত আদর্শের মধ্যে সংঘাতের জন্ম দেয়। উত্তর কোরিয়া ছিল কমিউনিস্ট এবং দক্ষিণ কোরিয়া ছিল পুঁজিবাদী। যুদ্ধ বিরতি চুক্তি হলেও কোনো শান্তি চুক্তি স্বক্ষরিত না হওয়ায় এখনো কোরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে লিপ্ত আছে।

লাল বিপদ বা লাল ভয় নামেও পরিচিত ছিল এই যুদ্ধ। সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বজুড়ে কমিউনিজমের বিস্তারের ভয়কে বোঝায়। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবে শিকড় গেড়ে থাকা এই কমিউনিস্ট বিরোধী অনুভূতি প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রস্ফটিত হয়, যার ফলে দুটি স্বতন্ত্র লাল ভয় দেখা যায়। আমেরিকানদের বিশ্বাস করায় যে কমিউনিজম অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য একটি হুমকি।

উত্তর কোরিয়ার বর্তমান প্রধান কিম জং উন তার দাদা কিম ইল সুং জাপানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন যে তার বাহিনীই সমগ্র কোরিয়ার বৈধ সরকার। ১৯৫০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় তার বাহিনী মার্কিন অধিকৃত দক্ষিণাংশে আক্রমণ করে যাতে দেশটিকে তার শাসনের অধীনে একত্রিত করা যায়।

তিনি অল্প সময়ের জন্য সফল হন কিন্তু মার্কিন পাল্টা আক্রমণে তার বাহিনীকে পিছু হটানো হয়। এ সময় চীনা সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর ৩৫ বছর ধরে জাপানের উপনিবেশে থাকা কোরিয়াকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৩৮ তম সমান্তরালে (অক্ষাংশের) দুটি দখলদারিত্ব অঞ্চলে বিভক্ত করে। যা আজও সীমানা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে বিশ্বের অনেক দেশ দুটি বৃহৎ বিজয়ী মিত্রের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পূর্ব
-পশ্চিম জার্মানি, উত্তর কোরিয়া- দক্ষিণ কোরিয়া এবং উত্তর ভিয়েতনাম- দক্ষিণ ভিয়েতনাম। দুই পরাশক্তিই নিজেদের ভাবমূর্তিতে সরকার তৈরি করেছে। দৃষ্টিভঙ্গিতে ভিন্নতার কারনে এই গোষ্ঠীগুলি একক জাতীয় আন্দোলনে একত্রিত হতে ব্যর্থ হয়।

কোরিয়া যুদ্ধ আসলে কখনোই শেষ হয়নি


উত্তর কোরিয়া আচমকা দক্ষিণ কোরিয়াকে আক্রমণ করে বসে। এই উপদ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নিতে পুঁজিবাদীদের উপর সমাজতন্ত্রীদের আক্রমণই কোরিয়া যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রে দুই কোরিয়ার যুদ্ধকে বর্তমানে ‘ফরগোটেন ওয়ার’ হিসাবে অভিহিত করা হয়। বিশ্লেষকদের মতে এ যুদ্ধের গভীরতা ব্যাপক। সাত দশক পরেও পুরানো সেই যুদ্ধ শেষ হয়নি।

আশা ছিল বিভক্তির পর পূর্ব এশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা হবে। শান্তিতে বসবাস করবে দুই কোরিয়ার সাধারণ মানুষ। কিন্তু দুই কোরিয়ার কেউই কাউকে আজ পর্যন্ত বৈধ হিসাবে গ্রহন করতে পারেনি। উত্তর কোরিয়ার আক্রমণের ফলে দুই পারমাণবিক শক্তির মধ্যে শুরু হয় প্রক্সি যুদ্ধ। এ যুদ্ধকেই স্নায়ু যুদ্ধের প্রথম আগুন বলা হয়ে থাকে।

মার্কিনীদের ধারনা ছিল দ্রুতই তারা জয়ী হবে, কিন্তু শীঘ্রই সে ধারনা ভুল প্রমাণিত হল। শুরুর দিকে উত্তর কোরিয়ার প্রায় ৩ মিলিয়ন সৈন্যের কাছে হিমশিম খেতে হয় জাতিসংঘের বাহিনী। সৈন্য পাঠানো থেকে শুরু করে সামরিক সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণের জন্য এগিয়ে আসে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন। উভয় পক্ষের সেনারা কাছাকাছি চলে আসে, তৈরি হয় এক বিপজ্জনক অচলাবস্থা।

হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে আলোচনার উদ্যোগ নিলে সেখানে দেখা যায় আরেক বিপত্তি। যুদ্ধবন্দীদের বিষয়ে একমত হতে ব্যর্থ হয় উভয়পক্ষ। ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই উত্তর কোরিয়া, চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। তবে চুক্তিতে আপত্তি জানায় দক্ষিণ কোরিয়া। রণক্ষেত্রে লড়াই থামলেও যুদ্ধ আসলে আজও শেষ হয়নি।

যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা


তিন বছরের ওই সংঘাতে কতজন মারা গিয়েছিল সেই হিসাবও এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। ধারনা করা হয় প্রায় ৪০ হাজার আমেরিকান সৈন্য এবং ৪৬ হাজার দক্ষিণ কোরিয়ার সৈন্য নিহত হয়েছিল। উত্তরের সংখ্যা আরও বেশি। ধারনা করা হয় ২ লাখ ১৫ হাজার উত্তর কোরিয়ান সৈন্য এবং চীনের ৪ লাখ সেনা মারা যায়। নিহতদের অধিকাংশই ছিল বেসামরিক নাগরিক।

যুদ্ধ শেষে অনেকের হদিশ মেলেনি আজও নিখোঁজ অনেকে। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রায় ৮০ হাজার সৈন্য ধরা পড়েছিল উত্তর কোরিয়ায়। এই যুদ্ধ বন্দীদের অধিকাংশেরই দেহাবশেষের কোনো হদিস মেলেনি। ২০২০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ১৪৭ যুদ্ধ বন্দীকে চিহ্নিত করে যুক্তরাষ্ট্র। যাদের দেহাবশেষ আগেই হস্তান্তর করে উত্তর কোরিয়া। সাড়ে সাত হাজারেরও বেশি মার্কিন সেনা আজও নিখোঁজ।

অনেকাংশে ভুলে যাওয়া কোরিয়া যুদ্ধের অস্থিরতা আজও বেঁচে আছে উভয় কোরিয়ায়। ১৯৫৩ সালে কোরীয় যুদ্ধ শেষ হলেও এ ব্যপারে আনুষ্ঠানিক কোনো চুক্তি হয় নি। জাতিসংঘ বাহিনীর পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র এবং উত্তর কোরীয় সেনাবাহিনী ও চীনের মধ্যে স্বাক্ষরিত অস্ত্র বিরতি চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। এ যুদ্ধে আড়াই থেকে তিন মিলিয়ন মানুষ হতাহত হয়।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url