ভিয়েতনাম যুদ্ধ দ্বিতীয় ইন্দোচীন যুদ্ধ নামেও পরিচিত

ভিয়েতনাম যুদ্ধ দ্বিতীয় ইন্দোচীন যুদ্ধ নামেও পরিচিত এবং ভিয়েতনামে আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ বা সহজভাবে আমেরিকান যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত চলা এ সংঘাত সরকারিভাবে উত্তর ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের মধ্যেকার লড়াই।

ভিয়েতনাম যুদ্ধ দ্বিতীয় ইন্দোচীন যুদ্ধ নামেও পরিচিত

এই যুদ্ধ স্নায়ুযুদ্ধ-যুগের প্রক্সিযুদ্ধ হিসাবে বিবেচিত

সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন এবং অন্যান্য কমিউনিস্ট মিত্রদেশ উত্তর ভিয়েতনামকে সমর্থন করে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, অস্ট্রেলিয়া, থাইলান্ড এবং অন্যান্য কমিউনিস্ট বিরোধী মিত্রদেশ দক্ষিণ ভিয়েতনামকে সমর্থন করে। কারও কারও মতে এই যুদ্ধ স্নায়ুযুদ্ধ-যুগের প্রক্সিযুদ্ধ হিসাবে বিবেচিত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান একটি ফরাসি উপনিবেশ ইন্দোচীন (ভিয়েতনাম, লাওস এবং কম্বোডিয়া) দখল করলে দখলদারদের প্রতিরোধ করার জন্য তাদের নেতা হো চি মিন ভিয়েতনাম জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ‘ভিয়েত মিন’ গঠন করেন। আমেরিকার সহায়তায় হো চি মিন জাপানিদের বিরুদ্ধে শুরু করেন গেরিলা যুদ্ধ এবং শেষ পর্যন্ত দেশটির নিয়ন্ত্রণ গ্রহন করেন।

কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন ভিয়েত মিনের বিরুদ্ধে প্রথম ইন্দোচীন যুদ্ধ থেকেই এই দ্বন্দ্বের উদ্ভব হয়েছিল। ১৯৫৪ সালে ফরাসিরা ইন্দোচীন ছেড়ে যাওয়ার পরে আমেরিকা দক্ষিণ ভিয়েতনামি রাজ্যের জন্য আর্থিক ও সামরিক সহায়তা গ্রহণ করেছিল। উত্তর ভিয়েতনামকে ইউএসএসআর এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীন বিমান ও প্রতিরক্ষা দিয়ে সমর্থন করেছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার নেতৃত্বে পুঁজিবাদের উত্থান ঘটে। অপর দিকে রাশিয়া ও চীনের নেতৃত্বে কমিউনিজম এর বিকাশ ঘটে। পুঁজিবাদী আমেরিকা ও তার পশ্চিমা সহযোগিরা কমিউনিজমকে বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী গণতন্ত্র পুঁজিবাদের বিকাশের হুমকিস্বরূপ মনে করে। ১৯৪৯ সালে মাও সেতুং এর হাত ধরে চীনে কমিউনিস্ট নেতৃত্ব আসে।

আবার কোরিয়া যুদ্ধে ১৯৫০ সাল থেকে আমেরিকা দক্ষিণ কোরিয়াকে সহায়তা করে আসছিল যাতে এই অঞ্চলে কমিউনিস্ট এর উত্থান না হয়। ফ্রান্সের উপনিবেশের আওতাধীন ইন্দো-চীন বলয়ের দেশগুলোতেও যাতে কমিউনিস্ট সরকার আসতে না পারে সে লক্ষেও আমেরিকা ফ্রান্সকে সহায়তা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ভিয়েতনাম ফ্রান্সের আওতাভূক্ত ছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান ভিয়েতনামকে দখল করে কিন্তু যখন জাপান পিছু হটে তখন ভিয়েতনামের জনগণ হো চি মিন এর নেতৃত্বে তাদের পছন্দের সরকারকে ক্ষমতায় বসায়। যুদ্ধের শেষে হো চি মিনকে আবার ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। ফ্রান্সের নেতৃত্বে ভিয়েতনামে আবার উপনিবেশ স্থাপন করে এবং বাও ডাই কে ক্ষমতায় বসানো হয়।

রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপ বাও ডাই কে প্রত্যাখান করে এবং হো চিন মিনকে দেশের প্রকৃত শাসক বলে মনে করে। আমেরিকার সামরিক সহায়তার মধ্যেও ফ্রান্সকে ভিয়েত মিন গেরিলাদের আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়। চীনে মাও সেতুং এর কমিউনিস্ট সরকার ভিয়েত মিন গেরিলাদের সরাসরি সাহায্য করতে শুরু করে। ১৯৫৪ সালে ফ্রান্স পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করে।

১৯৫৪ সালে জেনেভা কনফারেন্সে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ভিয়েতনামকে সাময়িকভাবে দুইভাগে ভাগ করে বাও ডাই এর নেতৃত্বে দক্ষিণ ভিয়েতনামের  সরকার এবং  হো চিন মিন এর নেতৃত্বে উত্তর ভিয়েতনাম গঠিত হবে। ভিয়েত মিনের সদস্যরা দক্ষিণ ভিয়েতনামের সাধারণ মানুষদের মাঝে কমিউনিজম ও কৃষি কাজে সাহায্য করে প্রভাব বিস্তার করে।

তৎকালীন জেনেভা চুক্তি মোতাবেক ঠিক করা হয়েছিল একটি নির্বাচন সংগঠিত হবে যেন দুই ভিয়েতনাম এক হয়ে যাবে এবং ভোটে যে দল জয়ী হবে সে দল ক্ষমতা গ্রহণ করবে ও গোটা ভিয়েতনাম এক শাসকের অধীনে থাকবে। কিন্তু নাদিম দিয়েন ভোটযুদ্ধে হেরে যাওয়ার ভয়ে এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন নি। নির্বাচন এড়িয়ে এককভাবে রাজত্ব করতে থাকেন।

উগ্র ক্যাথলিক নাও ধিন দিয়েম দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রকৃত শাসক। কমিউনিস্টরা ধর্মীয় কারনে তাকে প্রত্যাখান করলে আমেরিকা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। চরম স্বৈরাচারী ও দুর্নীতিবাজ এই সরকারকে আমেরিকা অব্যাহতভাবে সাহায্য করতে থাকে। যা যুদ্ধকে তরান্বিত করে। ভিয়েত মিন গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। হো চিন মিনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আক্রমণ শুরু করে।

আমেরিকা যে কোন উপায়ে কমিউনিজম প্রতিহত করতে চেয়েছিল। তাদের ভয় ছিল একটি দেশে কমিউনিজম খুঁটি গাড়লে তা অন্য দেশেও ছড়িয়ে পড়বে এবং পশ্চিমা দেশকে টেক্কা দিতে শক্তিশালী জোট গঠন করবে। যেহেতু উত্তর ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট হয়ে গেছে তাই দক্ষিণ ভিয়েতনামকে কমিউনিস্ট থেকে বাঁচাতে হবে। ফলে আমেরিকা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি ও বিরূপ প্রভাব

এই যুদ্ধে আমেরিকা ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হতে থাকে যা তাদের অর্থনীতিতে বিরুপ প্রভাব ফেলে এবং ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ১৯৭৩ সালে আমেরিকা ভিয়েতনাম ত্যাগ করে। এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ২ মিলিয়নের বেশি মানুষ মারা যায়। উভয় ভিয়েতনাম ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। এই যুদ্ধে তখন আমেরিকার ব্যয় হয় ৩৫০ বিলিয়ন ডলার।

১৯৬৫ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে আমেরিকার বিমান থেকে ৮ মিলিয়ন টন বোমা ভিয়েতনামে ফেলা হয়। দক্ষিণ ভিয়েতনামে ২০ মিলিয়ন গ্যালন ‘হারবিসাইডস’ ব্যবহার করে ঘন গাছপালা ধ্বংস করে যেন খুব সহজে ভিয়েত কং এর গেরিরাদের আক্রমণ করা যায়। ‘এজেন্ট অরেঞ্জ’ এক ধ্বংসাত্মক রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে লক্ষ লক্ষ হেক্টর বনভূমি ধ্বংস করে দেয়া হয়।

যুদ্ধে উত্তর ভিয়েতনামের ১.১ মিলিয়ন এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রায় ২ লাখ সৈন্য মারা যায়। আমেরিকার ৫৮২০০, দক্ষিন কোরিয়ার ৪০০০, অস্ট্রেলিয়ার ৫০০, থাইলান্ডের ৩৫০, নিউজিল্যান্ডের ৩ ডজনের মত সৈন্য মারা যায়। যুদ্ধ শেষ হলেও সেখানকার মানুষ বিভিন্ন সাইকোলজিক্যাল সমস্যায় ভুগছে। এই যুদ্ধে আমেরিকার সৈন্যদের মনোবল সম্পুর্ণ ভেঙ্গে যায়।

ভিয়েতনাম যুদ্ধ এমন একটি যেখানে কোনো পরাশক্তি টিকতে পারেনি। আমেরিকা যেখানে সর্বপ্রথম শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। সে সময় ক্যাপিটালিস্ট বনাম কমিউনিজমের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের প্রতিফলন দেখা দেয় ভিয়েতনামের উপরও। যার জন্য দেশটি দুভাগে ভাগ হয়ে পড়ে। উত্তরাংশ কমিউনিস্টদের আর দক্ষিনাংশ ক্যাপিটালিস্টদের।

১৯৫৫ সালের দিকে উত্তর ভিয়েতনামের নেপথ্যে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন। আর দক্ষিণ ভিয়েতনামমের উপর সমর্থন ছিল যুক্তরাষ্ট্র, ইউকে ও ফ্রান্সের। পরবর্তীতে দক্ষিণ ভিয়েতনাম উত্তর ভিয়েতনামের কাছে হেরে যায়। উত্তর ভিয়েতনামের রাজধানী আজও হ্যানয় আর দক্ষিন ভিয়েতনামের রাজধানী সাইগনের নাম রাখা হয় হো চিন মিন সিটি।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিশিষ্টতা

ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিশিষ্টতা হচ্ছে এটি ছিল একটি গেরিলা যুদ্ধ। যুদ্ধটি বিভিন্ন জঙ্গলে, গিরিপথে, নদীর ধারে, গুহায়, টিলায়, পাহাড়-পর্বতে সংগঠিত হয়। হেলিকপ্টার করে মার্কিন সৈন্যরা জঙ্গলে নামত। এ যুদ্ধে আসা-যাওয়ার কোন পথ ছিল না। নির্দিষ্ট কোন অঞ্চলও ছিল না। তাই মার্কিনীদের বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হত। যুদ্ধের সরঞ্জামও আনা নেয়া সম্ভব ছিল না।

গেরিলা যোদ্ধাদের কাছে হার মানতে হয় মার্কিন সেনাদের। এমন বৈরি পরিস্থিতির সাথে তারা পরিচিত ছিল না বলে শোচনীয় পরাজয় হয় আমেরিকার। অন্যদিকে ভিয়েত কং এর সেনারা জঙ্গলের সাথে খুবই পরিচিত কারন তাদের জন্ম ও বেড়ে উঠা এসব জঙ্গলে। হেলিকপ্টার থেকে দেখে ফেলার কারনে তারা মাটির নিচে সুড়ঙ্গ পথ তৈরি করে পাল্টা আক্রমণ করত।

একেকটা টানেলের নেটওয়ার্ক ছিল বিশাল। সেখানে খাদ্য ও অস্ত্রের যোগান সবই ছিল। অনায়াসে তারা এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে চলে যেতে পারত। আর মার্কিন সৈন্যদের নাজেহাল করতে খুব একটা বেগ পেতে হত না ভিয়েতনামিজ কংদের। ১৯৬৮ সালে একটি নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী আচমকা আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়।

এই আচমকা আক্রমণ বা ‘টেট অফেনসিভের’ পরে অনেকে আমেরিকার শক্তি সামর্থের উপর সন্দিহান হয়ে পড়ে। ভিয়েত কংরা এতবড় হামলা কিভাবে করতে পারল, তার মানে আমেরিকা ভূয়া খবর ছড়াচ্ছে- বলে প্রতিয়মান হয়। এ অন্যায় যুদ্ধের যৌক্তিকতা নিয়ে মার্কিন জনগণ প্রশ্ন তুলতে থাকে। গোটা আমেরিকায় যুদ্ধবিরোধী মনোভাব গড়ে উঠে।

আরেকটি ঘটনা হল, ‘ড্রাফট অপজিশন’। সে সময় আমেরিকান নাগরিকদের প্রায় সকলকে কিছু বছর সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে হত। মার্কিন সাধারণ জনগণ প্রতিবাদ করে এ যুদ্ধের বিরুদ্ধে ও এর যৌক্তিকতা নিয়ে। তারা বলতে থাকে, এ যুদ্ধ তো আমাদের দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট নয়, তাহলে আমরা কেন এ যুদ্ধে অংশ গ্রহন করব। শুরু হয় ড্রাফট অপজিশন।

আরেকটি বিষয় হল, ‘পেন্টাগন রিপোর্ট’। এ রিপোর্টে বলা হয়, সরকার মিথ্যা কথা বলছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে আগামী ছয়মাস কি বছরেও জেতা সম্ভব নয়, তারা ভূয়া প্রোপাগাণ্ডা ছড়াচ্ছে। এ খবর টেলিভিশনের মাধ্যমে জনগণের কাছে চলে যায়। ফলে জনগণ সরকার বিরোধী হয়ে যায়। সরকার জনপ্রিয়তা হারায়, ফলে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

এরইমধ্যে ১৯৬৮ সালের নির্বাচনে নিক্সন ভোটে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দেন, তিনি যদি ক্ষমতাসীন হন তবে যুদ্ধ বিরতী দিয়ে সৈন্য প্রত্যাবর্তন করবেন। তিনি ভোটে জয়লাভ করে ১৯৭০ সালে উত্তর ভিয়েতনাম থেকে সৈন্য সরিয়ে দক্ষিণ ভিয়েতনামে সৈন্য বাড়াতে থাকে। এ নীতিকে তিনি ‘ভিয়েতনামাইজেশন’ বলে আখ্যা দেন। ১৯৭৩ সালে প্যারিস শান্তি চুক্তির মাধ্যমে উভয় দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয় এবং মার্কিন সৈন্যরাও দেশে ফিরে যায়।

কিন্তু প্যারিস শান্তিচুক্তি স্বক্ষরিত হবার মাত্র দু বছরের মাথায় চীনের সহায়তায় উত্তর ভিয়েতনাম দক্ষিণ ভিয়েতনামকে আক্রমণ করে বসে। রাজধানী সাইগন দখল করে নেয়। তারাও অপেক্ষায় ছিল মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পর সম্মিলিত ভিয়েতনাম গঠন করবে। ১৯৭৫ সালে দুই ভিয়েতনামকে একত্রিত করে একটি নতুন কমিউনিস্ট স্বাধীন দেশের জন্ম হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়ের সাত কারন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি এবং সামরিক বাহিনীও একইভাবে শক্তিশালী। আট বছর ধরে ভিয়েতনাম যুদ্ধে বিপুল অর্থ ও জনবল ক্ষয়ের পরও যুক্তরাষ্ট্র তাদের কাছে পরাজিত হয়। কমিউনিস্ট এবং পুঁজিবাদী বিশ্ব তখন একে অপরের মুখোমুখি। এ যুদ্ধে পরাজয়ের সাধারণ কিছু ব্যাখ্যা দিয়েছেন দুজন বিশেষজ্ঞ :

১. যুদ্ধের দায়িত্ব ছিল বিশাল 

বিশ্বের অন্য প্রান্তে গিয়ে যুদ্ধ চালানো ছিল বিশাল এক দায়িত্ব। এ যুদ্ধে আমেরিকার ৫ লক্ষেরও বেশি সৈন্যসংখ্যা ছিল। যুদ্ধে মোট ব্যয়ের পরিমান ছিল ৬৮,৬০০ কোটি মার্কিন ডলার। এ যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে মার্কিন নেতাদের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ছিল না। মার্কিন সরকার নিশ্চিত ছিল যে ঐ যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত তারাই জয়ী হবে। কিন্তু সেই বিশ্বাসে ভাঙ্গন ধরলে ১৯৭৩ সালে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়।

২. এ ধরনের লড়ায়ের জন্য মার্কিন বাহিনী ছিল অনুপযুক্ত 

ভিয়েতনামের গহীন জঙ্গলে মার্কিন সৈন্যরা হিমসিম খাচ্ছে। অন্যদিকে ভিয়েত কং বিদ্রোহীরা অবলীলায় চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছে। ড. মিডাপের মতে হামলা চালানোর পর বিদ্রোহীরা লাওস এবং ক্যাম্বোডিয়ায় নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যেত। কিন্তু ঐ দুটি দেশে মার্কিন বাহিনীর প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। শুধু ভিয়েত কংদের বিরুদ্ধে মনোযোগ মার্কিনীদের পরাজয়ের পথে ধাবিত করে।

৩. যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয় ঘটে দেশের মধ্যেই 

ভিয়েতনাম যুদ্ধের খবর মূলত ছিল - নিরপরাধ বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা, পঙ্গু ও নির্যাতনের ছবিকে ঘিরে। টিভি এবং সংবাদপত্রে এসব খবর প্রচার করা হচ্ছিল। এতে অনেক আমেরিকান ভয় পেয়ে গিয়েছিল এবং তাদের মনোভাব যুদ্ধবিরোধী হয়ে পড়েছিল। সারা দেশে বিশাল বিশাল প্রতিবাদ বিক্ষোভ গজিয়ে উঠছিল।

৪. দক্ষিণ ভিয়েতনামের হৃদয় জয়ের লড়াইয়েও হেরেছে যুক্তরাষ্ট্র 

ভিয়েতনাম যুদ্ধ ছিল একটি ব্যতিক্রমী নৃশংস সংঘাত। এই যুদ্ধে আমেরিকা বিভিন্ন ধরনের ভয়ঙ্কর অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। উচ্চ তাপমাত্রার নাপাম বোমা এবং রাসায়নিক বোমা যা অরণ্যে গাছের আচ্ছাদন ধ্বংস করে করে। ফলে ফসল ধ্বংস হয়। এই অস্ত্র ব্যবহারের ফলে ভিয়েতনামের গ্রামীন জনগোষ্ঠীর মধ্যে আমেরিকার ব্যাপারে বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হয়।

৫. কমিউনিস্টদের মনোবল ছিল জোরালো 

ড. মিডাপ বিশ্বাস করেন কমিউনিস্টরা জয়ের ব্যাপারে দক্ষিণ ভিয়েতনামের পক্ষে লড়াইয়ের জন্য যাদের জোর করে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা হয়েছিল- তাদের চেয়ে অনেক বেশি অঙ্গীকারাবদ্ধ। বিপুল সংখ্যক গেরিলার হতাহতের পরেও কমিউনিস্ট শক্তিগুলির যে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল সেটা সম্ভবত তাদের মনোবলের প্রমাণ।

অন্যদিকে মার্কিন নেতৃত্ব মনে করছিল, যে হারে শত্রু যোগ দিচ্ছে তার চেয়েও দ্রুত হারে শত্রুকে হত্যা করতে পারলে কমিউনিস্টরা লড়াইয়ের ইচ্ছা হারিয়ে ফেলবে। যুদ্ধের সময় প্রায় ১১ লক্ষ যোদ্ধা নিহত হয়। তারপরও যুদ্ধের শেষ মহূর্ত পর্যন্ত তাদের সৈন্য সংখ্যা জুগিয়ে যেতে সক্ষম হয়। প্রচার ও শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে তারা মানুষকে বুলেটে পরিণত করতে সফল হয়েছিল।

৬. দক্ষিণ ভিয়েতনামের সরকার ছিল অজনপ্রিয় ও দুর্নীতিগ্রস্থ 

উত্তর এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের মধ্যে যে বিভাজন সেটা সবসময় ছিল কৃত্রিম, স্নায়ুযুদ্ধের ফলে এটি তৈরি হয়েছিল। ভিয়েতনাম বিভক্ত হওয়ার কোন সাংস্কৃতিক, জাতিগত বা ভাষাগত কারন ছিল না। দক্ষিণ ভিয়েতনামে জনসংখ্যার ১০% থেকে ১৫% ক্যাথলিকরা সংখ্যলঘু হয়েও আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ক্যাথলিকদের এই আধিপত্য বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠদের কাছে দক্ষিণ ভিয়েতনাম রাষ্ট্রকে অজনপ্রিয় করে তুলেছিল।

পাঁচ লক্ষ আমেরিকান সৈন্যের উপস্থিতি সেই সত্যটিকে তুলে ধরেছিল যে এই সরকার সব দিক থেকে বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল। ড. মিডাপ বলেন, দক্ষিণ ভিয়েতনাম কখনই মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়নি যে এ লড়াইটি ছিল তাদের বাঁচা-মরার লড়াই। মার্কিন অর্থ সাহায্য দেশটির দুর্নীতিকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে গেছে।

৭. কিছু সীমাবদ্ধতা যা উত্তর ভিয়েতনামের ছিল না 

অধ্যাপক ভু বলেন, দক্ষিণ ভিয়েতনামের জন্য ভাল হত যদি মার্কিন অস্ত্র ও তহবিল দিয়ে হলেও তারা যুদ্ধ জয়ের জন্য সবকিছু করতো। শেষ পর্যন্ত ঐ যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারণ করেছিল সামগ্রিকভাবে দীর্ঘ সময় ধরে উত্তর ভিয়েতনামের টিকে থাকার ক্ষমতা। যে প্রচেষ্টা দক্ষিণ ভিয়েতনামে দেখা যায় নি।

এর সাথে যোগ করে তিনি বলেন, দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রতি মার্কিন সমর্থনে ঘুণ ধরলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনের তরফ থেকে উত্তর ভিয়েতনামের প্রতি আর্থিক ও সামরিক সহায়তায় কোন নড়চড় হয়নি। কেবল মার্কিন সমর্থনের কারনেই দক্ষিণ ভিয়েতনামের সেনাবাহিনী টিকে থাকতে পারছিল। এ কারনেই এ যুদ্ধকে ভিয়েতনামী ভাষায় বলা হয় ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরোধ যুদ্ধ’।

১৯৫৪ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দক্ষিন চীন সাগর তীরের এক বিস্তীর্ণ জনপদে বয়ে যায় অবিরত রক্তের স্রোতধারা। এক পক্ষ মুক্তি চায় আর এক পক্ষ মুক্তির আকাঙ্খাকে গলা টিপে ধরতে চায়। ইতিহাস সাক্ষী লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে সে যুদ্ধে জয় হয়েছিল মুক্তিকামী মানুষেরই। অনাগত কাল ধরে মানুষের স্বাধীনতার প্রেরণার ইতিহাস তৈরি করা সেই জনপদের নাম ভিয়েতনাম।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url