প্রথম বিশ্বযুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হতে সাহায্য করেছিল

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৪ থেকে ১৮ সালে সংঘটিত একটি আন্তর্জাতিক সংঘাত। এ যুদ্ধ ছিল বিংশ শতাব্দীর ভূ-রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে চারটি সাম্রাজ্যের (জার্মানি, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি এবং তুরস্ক) পতন ঘটে। যুদ্ধটি ছিল কার্যত নজিরবিহীন যা মহাযুদ্ধ নামেও পরিচিত ছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হতে সাহায্য করেছিল

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ


প্রথমে এটি মহাযুদ্ধ এবং সমস্ত যুদ্ধের অবসান ঘটানোর যুদ্ধ নামে পরিচিত ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। বেশিরভাগ যুদ্ধ ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে সংঘটিত হয়েছিল। যুদ্ধটি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে অনেকেই ভেবেছিল যে কেউ আর কখনও আরেকটি যুদ্ধ শুরু করবে না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হতে সাহায্য করেছিল।

যুদ্ধবাজ দেশগুলোর উদ্দেশ্য ছিল অভিন্ন। যুদ্ধে অক্ষশক্তি কিংবা মিত্রশক্তি যাদের কথাই বলা হোক না কেন কেউ শক্তিমত্তার দিক থেকে পিছিয়ে থাকার পাত্র নয়। যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, জার্মান, ইতালি, কানাডা, ফরাসি, তুরস্ক, অস্ট্রো-হাঙ্গেরি, সার্বিয়া, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, গ্রিক কেউই শক্তি প্রদর্শনে পিছিয়ে থাকতে চাইনি। ফলাফল হিসাবে দীর্ঘ চার বছর স্থায়ী হয় এ যুদ্ধ।

এ যুদ্ধটি ছিল দুটি জোটের মধ্যে একটি বিশ্বব্যাপী ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক সংঘাত। যুদ্ধগুলি মূলত ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের পাশাপাশি আফ্রিকা এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরের কিছু অংশে সংঘটিত হয়েছিল। এসব যুদ্ধে আনুমানিক ১ কোটি সামরিক নিহত এবং ২ কোটিরও বেশি আহত হয়েছিল। গণহত্যা সহ প্রায় ১ কোটি বেসামরিক লোক মারা যায়।

যেভাবে বিশ্বযুদ্ধে মোড় নেয়


১৯১৪ সালে বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভো শহরে এক সার্বিয়াবাসীর গুলিতে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্কডিউক ফ্রানজ ফার্ডিনান্ড ও তার স্ত্রীকে হত্যাই মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করে। অস্ট্রিয়া এ হত্যাকাণ্ডের জন্য সার্বিয়াকে দায়ী করে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এ যুদ্ধে দু দেশের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ে। এভাবে প্রথম বিশ্বযেুদ্ধের সূচনা হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে একপক্ষে ছিল অস্ট্রিয়া, জার্মানি, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া যাদের বলা হত কেন্দ্রীয় শক্তি। আর অপর পক্ষে ছিল সার্বিয়া , রাশিয়া বৃটেন, ফ্রান্স, জাপান, ইতালি ও আমেরিকা যাদের বলা হত মিত্রশক্তি বা অক্ষশক্তি। অস্ট্রিয়ার দ্বারা সার্বিয়া আক্রমণের পরপর জার্মানি-অস্ট্রিয়ার সাথে ফ্রান্স-রাশিয়া যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এরপর সার্বিয়ার পক্ষে রাশিয়া এবং জার্মানির পক্ষে উসমানী খেলাফত যোগ দেয়।

জার্মান কর্তৃক নিরপেক্ষ বেলজিয়াম আক্রান্ত হলে বৃটেন জার্মানির বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় বিপ্লবের ফলে যুদ্ধ ত্যাগ করে নিজেদের ঘর সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজে করে ফ্রান্স বৃটেনের জন্য রসদ পাঠানোর সময় জার্মান সাবমেরিন জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে যুক্তরাষ্ট্র জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারনগুলির মধ্যে ছিল জার্মানির উত্থান এবং অটোমান সাম্রাজ্যের পতন যা ইউরোপে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষমতার ভারসাম্যকে বিঘ্নিত করেছিল। শিল্পায়ন ও সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মধ্যে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা। নব্য ও উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রসার, দেশগুলোর পরস্পর পূর্ব শত্রুতার জের, কাঁচামাল সংগ্রহ এবং তৈরি পণ্য বিক্রির জন্য উপনিবেশ স্থাপনে প্রতিযোগিতা ইত্যাদি বিষয় বিশ্বযুদ্ধের পেছনে কাজ করেছে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যালান্স অফ পাওয়ার ঠিক রাখা এবং পূর্বের সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখার মাধ্যমে নিজেদেরকে সুরক্ষিত রাখার জন্য প্রায় সবাই পছন্দমত দেশ ও সাম্রাজ্যের সাথে অনেক আগে থেকে বিভিন্ন আঙ্গিকে মৈত্রি চুক্তিতে আবদ্ধ ছিল। যুদ্ধটি বিশ্বযুদ্ধে রূপান্তরিত হওয়ার জন্য অন্যান্য বিষয়ের সাথে এ চুক্তির টানও ছিল বিপুল লক্ষ্যণীয়।

কিছু ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপও এই যুদ্ধ শুরুর অন্যতম কারন বলে বিবেচনা করা হয়। জার্মান সাবমেরিনের অবাধ চলাচলের ফলে বৃটিশ যাত্রীবাহী জাহাজ ডুবে যাওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে জার্মানদের কুটচালের কথা। ভার্সাই চুক্তির ফলে জার্মানরা অনেক এলাকা ছেড়ে দিতে এবং ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়। সে সময়ে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ভার্সাই চুক্তি সম্পাদন করেন কিন্তু সিনেটে অনুমোদন করাতে ব্যর্থ হন।

১৯১৭ সালে বলশেভিকরা রাশিয়া দখল করলে কেন্দ্রীয় শক্তির সাথে রাশিয়া যুদ্ধ বিরতি করে। ১৯১৮ সালে শুরু হওয়া মিত্রশক্তির শত দিনের আক্রমণ জার্মান ফ্রন্ট লাইনের পতন ঘটায়। ভার্ডার আক্রমণের পর বুলগেরিয়া যুদ্ধবিরতি করে। অটোমান সাম্রাজ্য এবং অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি উভয়েই যুদ্ধ বিরতি করে। ফলে জার্মানি বিচ্ছন্ন হয়ে পড়লে ১৯১৮ সালে যুদ্ধ শেষ হয়।

যুদ্ধের ফলাফল


আগে যদিও সামনাসামনি যুদ্ধ হত, বর্তমানে মেশিনগান, কামান, ট্যান্ক, বোমা প্রভৃতির ব্যবহারে মানুষ সামনাসামনি লড়াইয়ে আর আগ্রহী নয়। ১৯১১ সালে প্রথম বিমান ব্যবহৃত হয়। জার্মানিরা যুদ্ধে প্রথম ক্লোরিন গ্যাস ব্যবহার করে যা অত্যন্ত বিপদজনক, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মানুষ মারা যায়। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে রাজনীতিতে বিরাট পরিবর্ত আসে এবং অনেক দেশে বিপ্লবেরও সূচনা করে।

চারটি সাম্রাজ্যের পতন হয় যেমন- রাশিয়া, অস্ট্রো-হাঙ্গেরি, জার্মান ও উসমানীয় সাম্রাজ্য। কিছু দেশ পুনরায় স্বাধীনতা পায়, কিছু দেশ নতুনভাবে বহুমুখী চুক্তিতে আবদ্ধ হয়, যেমন- জার্মানিতে ১ লাখের বেশি সৈন্য হওয়া যাবে না, ট্যাংক, যুদ্ধবিমান, সাবমেরিন ইত্যাদি নেয়া যাবে না । পুরো যুদ্ধের দায় জার্মানির উপর পড়ে। জার্মানিকে প্রায় ৩৩ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপুরণ দিতে হয়।

১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে এ যুদ্ধের সমাপ্তি হয়। এতে কেন্দ্রীয় শক্তি পরাজিত হয়। কয়েক কোটি মানুষ নিহত ও আহত হয় এবং অসংখ্য মানুষ নিখোঁজ হয়। চারটি সাম্রাজ্য ভেঙ্গে টুকরা টুকরা হয়ে যায়। তুরস্ক ছাড়া বাকি সকল এলাকা ফ্রান্স ও বৃটেন ভাগ করে নেয়। এ যুদ্ধ ছিল পৃথিবীর জন্য এক ভয়াবহ দুর্দিনের কাল। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গঠিত হয় জাতিসংঘ।

এ মহাযুদ্ধে প্রায় ১৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রত্যক্ষ ও ১৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পরোক্ষ খরচ হয়। ইতিপুর্বে যে কোন যুদ্ধব্যায়ের চেয়ে অনেক বেশি। ১৯২২ সালে ফ্যাসিস্টরা ইতালির ক্ষমতায় আসে। আমেরিকা তুরস্কে গণহত্যা চালায়। ইনফ্লুয়েঞ্জায় বিশ্বব্যাপী ২৫ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়।

প্রভাব ও পরিনাম


প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সারা পৃথিবীর রাজনৈতিক চরিত্র বদলে যায়। এটি মূলত ছিল একটি পরিবর্তনকারী বিপ্লব। ফলাফলগুলি নিম্নরূপ-

১. প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে সাম্রাজ্যের পতন, নতুন রাষ্ট্রের জন্ম এবং বিশ্বের মানচিত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে।

২. এই যুদ্ধের ফলে মধ্যপ্রাচ্য ও ভিয়েতনামে ঔপনিবেশিক বিদ্রোহের সূচনা হয়।

৩. সারা পৃথিবীতে আর্থিক মন্দা ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। জার্মানির অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মানব নির্মিত দুভিক্ষের জন্ম হয়।

৪. শক্তিসাম্যের ব্যাপক পরিবর্তন হয়। পূর্বের আধিপত্যবাদী শক্তিগুলির আধিপত্য বিনষ্ট হয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জাপান ও আমেরিকার আত্মপ্রকাশ ঘটে।

৫. ইউরোপে জাতীয়তাবাদের ব্যাপক প্রসার ঘটে। ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলিতে বিভিন্ন জাতির জাতীয়তাবাদী আকাঙ্খা পূরণ করা হয়। স্বাধীনতাকামী রাষ্ট্রগুলিকে নুতুন করে পুনর্গঠন করা হয়।

৬. পূর্ববর্তী সময়ের রাজনীতি নিয়ন্ত্রক রাষ্ট্রগুলি ব্যাপক ধ্বংস ও ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এই পরিস্থিতিতে রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার আত্মপ্রকাশ ঘটে।

৭. ১৯০৫ সালের পর থেকে রাশিয়ায় স্বৈরতান্ত্রিক জার শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়ে রুশ বিপ্লবের ফলে দীর্ঘ ৩০০ বছরের জার শাসনের অবসান ঘটে। বুর্জোয়া শাসনের অবসান হয়ে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়।

৮. বিভিন্ন শ্রমিক শ্রেণীর সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং শ্রমিক সংগঠন গড়ে উঠে। শ্রমিক স্বার্থ রক্ষায় শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা হয়।

৯. এ যুদ্ধের পর সারা পৃথিবীব্যাপী নারীদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীদের অংশ গ্রহন বৃদ্ধি পায়। নারী স্বাধীনতার প্রসার ঘটে।

১০. ভার্সাই চুক্তিতে জার্মানিকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক দিক দিয়ে পঙ্গু করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির অভাবে এই চুক্তি মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরি হয়।

মিত্রশক্তির শান্তির স্বপ্ন বেশিদিন টিকেনি। জার্মান জনগণ শাস্তি পেতে পছন্দ করেনি। তারা ১৯৩৩ সালে এডলফ হিটলারকে ক্ষমতায় আনে। তিনি জার্মান সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। তার কর্মকাণ্ড শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে পরিচালিত করে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url