খন্দক যুদ্ধ ছিল এক প্রকার বুদ্ধির যুদ্ধ

খন্দক ফারসি শব্দ, যার অর্থ পরিখা। পরিখা বা খান্দাক থেকে এ যুদ্ধের নামকরণ করা হয়েছে যা মুসলমানরা প্রতিরক্ষার জন্য খনন করেছিল। এ যুদ্ধকে মৈত্রী যুদ্ধ এবং কনফেডারেটদের যুদ্ধ নামেও উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন দল একত্রিত হয়ে যুদ্ধ করার কারনে এটি আহযাবের যুদ্ধ নামেও পরিচিত।

খন্দক যুদ্ধ ছিল এক প্রকার বুদ্ধির যুদ্ধ

খন্দক যুদ্ধে মুসলমানরা কৌশলে শত্রুদের পরাজিত করে


খন্দকের যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব গোত্রগুলোর এক সর্বাত্মক হামলা। এ যুদ্ধের সময় আরব এবং ইহুদি গোত্র সমূহ মদিনাকে ঘিরে ফেলে এবং ২৭ দিন অবরোধ করে রাখে। মৈত্রী বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১০,০০০ জন, যাদের কাছে ৬০০ টি ঘোড়া এবং কিছু উট ছিল। আর মদিনার রক্ষীদের সংখ্যা ছিল ৩০০০ জন। এ যুদ্ধ শুরু হয় পঞ্চম হিজরীর শাওয়াল মাসে।

এ যুদ্ধ ছিল এক প্রকার বুদ্ধির যুদ্ধ। খন্দক যুদ্ধে মুসলমানরা কৌশলে শত্রুদের পরাজিত করে এবং খুব কম ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। শত্রুদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার ফলে ইসলাম এ অঞ্চলে প্রভাবশালী হয়ে ওটে। মুসলিম বাহিনী বনু কুরাইজা গোত্রের এলাকায় অবরোধ করলে তারা নিঃশর্ত আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়। এ পরাজয় মক্কাবাসীর বাণিজ্য ও সম্মান হানি ঘটায়।

রাসুল সা. মদিনায় আসার আগে বনু নাজির ও বনু কোরায়জা নামে সেখানে দুটি বড় ইহুদী গোষ্ঠী বসবাস করত। তাদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্য গোত্রগুলো মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। ওহুদের যুদ্ধে কুরাইশরা সাময়িক জয়লাভ করলেও তাদের কোন উদ্দেশ্যই অর্জিত হয়নি। তারা রাসুল সা. এর শক্তি, সম্মান ও মর্যাদা দুর্বল করতে পারেনি।

কুরাইশরা তাই তাদের ধর্মীয়, সামাজিক এবং বাণিজ্যিক সুবিধা বৃদ্ধির জন্য আরেকটি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। তারা শুনতে পেল যে আগামী বছর আবু সুফিয়ান বদর প্রান্তরে মুসলিমদের সাথে পুনরায় যুদ্ধ করবে। তখন তাদের সাহস আরও বেড়ে যায়। তারা মক্কায় গিয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে কুরাইশদের ক্ষেপিয়ে তুলতে লাগল এবং কুরাইশদের সাহায্য করার পূর্ণ আশ্বাস প্রদান করল।

ইহুদীদের আগ্রহ দেখে কুরাইশদের সাহস আরও বেড়ে গেল এবং তরা রণপ্রস্তুতি নিতে শুরু করল। এ লক্ষ্যে তারা মুহাম্মদ সা. এর বিরদ্ধে অন্যান্য গোত্রকে যুদ্ধ করার জন্য উসকানি দিতে থাকে। যার ফলে আরেকটি যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। অল্প সময়ের মধ্যেই আরব গোত্রের ১০ হাজার যোদ্ধা প্রস্তুত হয়ে গেল। সেনাপতি হিসাবে ছিল আবু সুফিয়ান।

যুদ্ধের প্রস্তুতি


রাসুলুল্লাহ সা. শত্রুদের মোকাবেলা করার জন্য সাহাবাদের নিয়ে পরামর্শে বসলেন। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফার্সির পরামর্শে পরিখা খননের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মদিনার দক্ষিণে ঘন খেজুর বাগান দ্বারা সুরক্ষিত ছিল আর পূর্ব দিকে বনু কুরাইজার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক ছিল। তাই মদিনার উত্তর ও পশ্চিম দিকে পরিখা খনন করা হয়। প্রায় ৩০০০ মুহাজির ও আনসারদের সাথে নিয়ে রাসূল সা. কঠোর পরিশ্রম করে এক সপ্তাহে খনন কাজ শেষ করেন।

আরবীয় যুদ্ধ কৌশলে পরিখা খনন প্রচলিত ছিল না। মুসলিমদের এই পরিখা খননের কারনে জোট বাহিনী অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। মহানবী সা. এর অভিনব কৌশল দেখে বিস্মিত হলো। পরিখা পার হওয়ার কোনো ব্যবস্থা তাদের ছিল না। দুই বাহিনী পরিখার দুই পাশে এসে সমবেত হয়। দিনের পর দিন দুই বাহিনী পরস্পরকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করে চলছিল। কুরাইশ সেনারা অধৈর্য হয়ে পড়ে।

৬২৭ খৃস্টাব্দের ৩১ মার্চ যুদ্ধ শুরু হল। কুরাইশ বাহিনী পরিখা অতিক্রম করে হামলা চালাতে বারবার ব্যর্থ হয়। তারা ২৭ দিন মদিনা অবরোধ করে রাখে। যতই দিন যায় খাদ্য ও রসদের অভাব দেখা দেয়। প্রচণ্ড শীতের মধ্যে প্রবল ঝড় ও বাতাসে তাদের তাঁবু উড়ে যায়। ছিন্ন ভিন্ন হয়ে হয়ে গেল তারা। ফলে আবু সুফিয়ান অবরোধ ত্যাগ করে মক্কায় ফিরে যায়।

যুদ্ধের কারন


খন্দকের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল মূলত ইহুদী উপজাতি বনু নাদিরের উসকানির ফলে। নবী সা. কে হত্যা চেষ্টার কারনে তাদেরকে মদিনা থেকে বহিস্কার করা হয়। বিতাড়িত হয়ে মদিনার দেড়শ কিলোমিটার উত্তরে খায়বার নামক স্থানে বসতি স্থাপন করে। তারা হারানো জমি ফিরে পাওয়ার আশায় মক্কার কুরাইশদের কাছে একটি প্রতিনিধি দল পাঠায়।

প্রতিনিধিদল কুরাইশদের কাছে গিয়ে বলে, ‘এসো আমরা বনু নাদির ও কুরাইশ একে অপরকে সাহায্য করি যাতে আমরা একই সঙ্গে মুসলিমদের আক্রমণ করতে পরি।’ তারা আরও বলে, ‘তোমাদের যত টাকা প্রয়োজন তা আমরা দেব।’ সিরিয়ার বাণিজ্য পথ বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার ফলে আর্থিকভাবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। তাই মুসলিমদের মোকাবেলা করার উপায় খুঁজছিল।

ওহুদের যুদ্ধে কুরাইশরা পুরোপুরি বিজয় অর্জন করতে পারেনি। মুসলিমদের শৌর্য-বীর্য ও সাহসিকতা দেখে তারা এককভাবে যুদ্ধ করারও সাহস পাচ্ছিল না। এই অবস্থায় বনু নাদিরের কাছ থেকে প্রস্তাব আসল। এটা ছিল কুরাইশদের জন্য একটা বড় লোভনীয় সুযোগ। যে কুরাইশরা ইহুদিদের সমীহ করে চলত সেই ইহুদিরা এখন তাদের তাদের সঙ্গে আলোচনা করছে- এটা একটা বিম্ময়কর ঘটনা।

আলোচনার এক পর্যায়ে আবু সুফিয়ান জিজ্ঞেস করল- ‘তোমরা তো মুহাম্মদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আমাদের কাছে এসেছ, সন্দেহ নাই, যেই তার বিরুদ্ধে লড়াই করবে সেই আমাদের প্রিয়। তবে তার আগে আমাকে উত্তর দাও, কার ধর্ম তোমাদের ধর্মের কাছাকাছি? আমাদের না মুহাম্মাদের’? ইহুদি ধর্মের সাথে মুসলিমদের অনেক মিল থাকার পরও সংঘাত ও বৈরী সম্পর্ক। এই জটিল সমীকরণ বুঝতে কুরাইশদের অসুবিধা হচ্ছিল।

আবু সুফিয়ানের প্রশ্নের জবাবে বনু নাদিরের নেতারা বলল, ‘মুহাম্মদ ও তার সাহাবিদের চেয়ে আমরা বেশি হেদায়েতপ্রাপ্ত এবং আমরাই সত্যের বেশি কাছাকাছি।’ এমন জবাবে আল্লাহ তাদের মুখোশ ও চক্রান্ত উম্মোচন করে বলেন, তুমি কি তাঁদের দেখনি যাদের কিতাবের এক অংশ দেওয়া হয়েছিল? তারা ভিত্তিহীন কুহেলিকা এবং অশুভ ক্ষমতায় বিশ্বাস করে। তারা কাফেরদের সম্বন্ধে বলে যে, মুমিনদের চেয়ে এদের পথই ভালো। (সুরা নিসা ৫১)

পরিখা খননের সময় কয়েকটি অলৌকিক ঘটনা


এক. পরিখা খননের সময় জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা. রাসূল সা. কে ক্ষুধার্ত অবস্থায় দেখে বাসায় একটি ভেড়া জবাই করে রান্না করলেন। রাসূল সা. সহ কয়েকজনকে খেতে আসতে অনুরোধ করলেন। রাসূল সা. পরিখা খননের সবাইকে নিয়ে খেতে গেলেন। তারা সকলেই পেট পুরে খেলেন অথচ আশ্চর্যজনকভাবে পাতিলের গোশত পূর্বের মতই থেকে গেল। একটুও কমলোনা।

দুই. পরিখা খননের সময় এক মহিলা এক মুষ্টি খেজুর এনে রাসূল সা. কে দিলেন। রাসূল সা. খেজুরগুলো তাঁর চাদরে রেখে সাহাবীদের ডেকে খেতে বললেন। সবাই খেতে থাকল অথচ খেজুরের সংখ্যা বেড়েই চলল।

তিন. পরিখা খননের সময় একটি কঠিন পাথর বাধা হয়ে দেখা দিল। বিষয়টি রাসূল সা. কে জানানো হলে তিনি একটি কোদাল নিয়ে পাথরটিকে সামান্য আঘাত করতেই পাথরটি টুকরা টুকরা হয়ে মরুভূমির বালিতে পরিণত হয়ে গেল। এ রকম ঐশ্বরিক শক্তির প্রকাশ সাহাবীদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল।

চার. প্রায় ২৭ দিন মদিনা অবরোধের পর এক সময় আল্লাহ প্রবল ঝড়ো হাওয়া পাঠান। এই ঝড়ো হাওয়া মিত্র বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তাদের সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। তারা মদিনা ছেড়ে চলে যায়।

যুদ্ধের ফলাফল


মুশরিকরা চলে যাওয়ার পর রসূল সা. মদিনায় প্রবেশ করে যুদ্ধের হাতিয়ার খোলা শুরু করলেন। তখন জিব্রাইল ফিরিশতা এসে বললেন- ‘আপনারা অস্ত্র রেখে দিচ্ছেন? অথচ আল্লাহর ফিরিশতাগণ এখনও যুদ্ধের পোশাক খুলেন নি’। নবী সা. সাহাবিদের নিয়ে বের হয়ে পড়লেন। ইহুদীরা প্রতিরোধ করলেও শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়। কেউ কেউ নিহত হল আর বাকীরা বন্দী হল। এ যুদ্ধে মুসলিমদের দশজন শহীদ হয়।

মহানবী সা. এর রাজনৈতিক দুরদর্শিতা আর রণকৌশলে মুসলমানরা এ যুদ্ধে জয়লাভ করে। অপরদিকে ইহুদীদের সম্মিলিত বাহিনী পরাজিত হয়। মুসলমানদের ঐক্য, শৃঙ্খলা এবং দৃঢ় মনোবলের পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং খাদ্য-রসদের সংকট কাফিরদের পরাজয়ের অন্যতম কারণ।

এ যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে কাফিরদের দম্ভ শেষ হয়ে যায়। তাদের সামরিক শক্তির দুর্বলতা প্রকাশ পায়। অপরদিকে মহানবী সা. এর প্রভাব ও প্রতিপত্তি বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। মুসলমানদের ধর্ম ও বাণিজ্য প্রসারের সকল বাধা দুর হয়ে যায়। মদিনার আশেপাশে মুসলমানরা প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। ফলে তারা স্বেচ্ছায় মুসলমানদের মিত্রে পরিণত হয়।

বদরের যুদ্ধ অপেক্ষা পরিখার যুদ্ধের গুরুত্ব কোন অংশে কম নয়। কারন বদরের প্রান্তরে মক্কার পাপিষ্ঠ কুরাইশদের পরাজিত করে ইসলামকে মদিনায় সুপ্রতিষ্ঠিত করা হয়। অপরদিকে পরিখার যুদ্ধে বেদুইন, ইহুদী ও কুরাইশদের সম্মিলিত শক্তিকে ধ্বংস করা হয়। মদিনায় মুসলিম রাষ্ট্রের ভিত্তিমূল সুদৃঢ় হয়। অল্প সময়ের মধ্যে পাশ্ববর্তী দেশগুলোতে বিস্তৃতি লাভ করে।

পরিখার যুদ্ধের গুরুত্ব বিবেচনা করে জোসেফ হেল বলেন- ‘পরিখার যুদ্ধের ফলাফল ছিল সংখ্যাধিক্য শক্তির উপর শৃঙ্খলা ও একতার নব বিজয়’। ওহুদের যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি ঘটলে ইসলাম ধ্বংসপ্রাপ্ত হত। আল্লাহর প্রতি অবিচল বিশ্বাস, একতা ও আত্মোৎসর্গের এক বলিষ্ঠ নেতৃত্ব অক্ষরে অক্ষরে পালন করে বিজয় সুনিশ্চিত করে।

খন্দকের যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে একটি মোড় পরিবর্তন ও যুগান্তকারী যুদ্ধ। এ যুদ্ধে সম্মিলিত খোদাদ্রোহী শক্তি চরমভাবে পরাজিত ও লাঞ্ছিত হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। আর মহানবী সা. বিজয়ী বেশে বিশ্বের বুকে ইসলামের অমীয় বাণী ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url