ওহুদ যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে সংঘটিত যুদ্ধসমূহের মধ্যে দ্বিতীয়

ওহুদ যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। তৃতীয় হিজরির শাওয়াল মাসে মদিনার অদুরে ওহুদ পর্বতের পাদদেশে মুসলিম ও কুরাইশদের মধ্যে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে মুসলিমরা প্রথমে বিজয় লাভ করলেও পরবর্তীতে কৌশলগত ভুলের কারনে পরাজয় হয়।

ওহুদ যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে সংঘটিত যুদ্ধসমূহের মধ্যে দ্বিতীয়

ওহুদ যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে সংঘটিত যুদ্ধসমূহের মধ্যে দ্বিতীয়


সৌদি আরবের মদিনা শহরের উত্তরে অবস্থিত বিখ্যাত ওহুদ পাহাড়। বদর যুদ্ধের ঠিক এক বছর পর ৬২৫ সালে ওহুদ যুদ্ধ হয়। ওহুদ যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে সংঘটিত যুদ্ধসমূহের মধ্যে দ্বিতীয়। দুই পক্ষের নেতৃত্বে ছিলেন যথাক্রমে মুহাম্মদ সা. ও আবু সুফিয়ান। এ পাহাড়ের উচ্চতা ৩৫৩৩ ফুট। মাথা উচু করে থাকা এ পর্বতকে মদিনা শহর থেকে দেখা যায়।

বদরের যুদ্ধে বাজেভাবে পরাজিত হয়ে মক্কার কুরাইশদের মনে প্রতিহিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছিল। প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিল না তারা। মুসলিমদের হাতে তাদের বীর যোদ্ধা আবু জাহেল ও উতবার মৃত্যু কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিল না। তাই দ্রুত আরও একটি যুদ্ধের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে কুরাইশরা।

কিনানা ও তিহামা গোত্রের লোকেরা একেবারে প্রস্তুত হয়ে গেলেন। হাবশিরা বর্শা নিক্ষেপে বেশ পারদর্শী, যাদের তির লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না। ওয়াহশি নামের এক হাবশিকে মুসলমানদের হত্যার বদলে মুক্তির প্রলোভন দেয়া হয়। যুদ্ধে অংশ গ্রহনের জন্য বিভিন্ন গোত্রগুলিকে আহ্বান জানানো হয়। যুদ্ধের সার্বিক প্রস্তুতি শেষে আবু সুফিয়ান তার বাহিনী নিয়ে মদিনার দিকে রওনা হয়।

আবু সুফিয়ান বাহিনীর মধ্যস্থলে নিজ কেন্দ্র তৈরী করেন। বাম পার্শের নেতৃত্বে ছিলেন ইকরিমা ইবনে আবি জাহল এবং ডান পার্শের নেতৃত্বে ছিলেন খালিদ বিন ওয়ালিদ। পদাতিক ও তীরন্দাজদের নেতৃত্বে ছিলেন যথাক্রমে সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া ও আব্দুল্লাহ ইবনে রাবিয়াহ। রীতি অনুযায়ী বনু আবদ আদ-দার গোত্রের একটি দল মক্কা বাহিনীর পতাকা বহন করছিল।

যুদ্ধের খরচ মেটানোর জন্য আবু সুফিয়ানের বাণিজ্য কাফেলায় যাদের ব্যবসা আছে, তারা শুধু মূলধন ফেরত পাবে এবং লভ্যাংশের টাকায় সামরিক শক্তি অর্জন করে মুসলমানদের ওপর প্রতিশোধ নেয়া হবে। এই সম্পদের পরিমাণ ছিল এক হাজার উট এবং পঞ্চাশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা। ঘরে ঘরে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। গানে গানে যোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধির জন্য সঙ্গে নেয়া হল নারীদের।

আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ৩০০০ মক্কার সৈনিকের একটি বাহিনী ৬২৫ সালে মদিনার দিকে যাত্রা শুরু করে। এই বাহিনীর সাথে ৩০০০ উট ও ২০০টি ঘোড়া ছিল। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা সহ মক্কার ১৫ জন নারীও যুদ্ধক্ষেত্রে আগমন করে। তাদের ধারনা নারীরা সাথে থাকলে আমরণ লড়ায়ের উদ্দীপনা তৈরী হবে। তারা সরাসরি মদিনা আক্রমণ না করে ওহুদের নিকটবর্তী স্থানে শিবির স্থাপন করে।

কুরাইশদের যুদ্ধযাত্রার খবর মুহাম্মদ সা, এর কাছে পৌঁছায়। মদিনার বিভিন্ন স্থানে আকষ্মিক আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। মুহাম্মদ সা. নিজের দেখা একটি স্বপ্নের কথা জানান। তিনি বলেন, ‘আমি দেখি যে কতগুলো গাভী জবাই করা হচ্ছে। আরো দেখি যে আমার তালোয়ারের মাথায় কিছু ভঙ্গুরতা রয়েছে এবং আমার হাত একটি সুরক্ষিত বর্মের মধ্যে ঢুকিয়েছি।’

স্বপ্নের ব্যাখা হিসাবে তিনি বলেন, কিছু সাহাবি নিহত হবে, তলোয়ারের ভঙ্গুরতার অর্থ তার পরিবারের কেউ শহীদ হবে এবং সুরক্ষিত বর্মের অর্থ মদিনা শহর। পদক্ষেপ নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল। মুহাম্মদ সা. সহ কারো কারো মত ছিল শহরের ভেতর থেকেই প্রতিরোধ করা হলে সহজে তাদের আক্রমণ করা যেত এবং নারীরাও ছাদের উপর থেকে পাথর ছুড়তে পারত। অন্যদের দাবি ছিল শহরের ভিতর থেকে প্রতিরক্ষা করলে শত্রুদের মনোবল বৃদ্ধি পাবে। বরং খোলা ময়দানে লড়াই করলে ভবিষ্যতে তারা সহজে আক্রমণ করতে সাহস পাবে না।

এর ফলে মদিনার বাইরে গিয়ে শত্রুর মোকাবেলার সিদ্ধান্ত হয়। মুসলিমদের মোট সেনা সংখ্যা ছিল ১০০০। এর মধ্যে ১০০ জন বর্ম পরিহিত এবং ৫০ জন ছিল অশ্বারোহী। মুহাম্মদ সা. বাহিনীকে তিন ভাগে বিভক্ত করেন। মুহাজির বাহিনী, আউস বাহিনী ও খাজরাজ বাহিনী। যথাক্রমে এই তিন বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন মুসআব ইবনে উমায়ের, উসাইদ ইবনে হুজাইর ও হুবাব ইবনে মুনজির।

প্রায় ১০০০ মুসলিম বাহিনী মদিনা থেকে যুদ্ধের জন্য বের হয়। শহরের বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করায় আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ৩০০ অনুসারী নিয়ে দলত্যাগ করে। এর ফলে ৭০০ যোদ্ধা নিয়ে মুসলিমরা ওহুদের দিকে কৌশলে ভিন্ন একটি পথে যাত্রা করে। মুসলিমরা উপত্যকার শেষ প্রান্তের ওহুদ পর্বতে শিবির স্থাপন করে। এই অবস্থানে মুসলিমদের সামনে ছিল মক্কার বাহিনী ও পেছনে ছিল ওহুদ পর্বত।

ওহুদের যুদ্ধ


শেষ পর্যন্ত ৭০০ জন মুজাহিদ নিয়ে মুসলিম ও কাফেরদের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সংখ্যায় কম হওয়া সত্বেও মুসলিমরা প্রথমদিকে বিজয় লাভ করে এবং মক্কার সৈনিকরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। মুসলিম বাহিনীর কিছু অংশের ভুলের কারনে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। ওহুদের নিকটে রোমান পাহাড়ের একটি সঙ্কীর্ণ গিরিপথ প্রহরায় ৪০ জন সাহাবীকে নিয়োজিত রেখেছিলেন।

রাসূল সা. নির্দেশ দিয়েছিলেন কোনো অবস্থাতেই তারা যেন এই প্রহরা থেকে সরে না যান। এমনকি সম্মুখের বাহিনীর গোস্ত ছিড়ে খাওয়া দেখলেও তারা যেন প্রহরা থেকে নিবৃত না হয়। যুদ্ধের প্রথম দিকে কাফের বাহিনী পিছু হটতে থাকে। প্রবল বিশ্বাসে এগিয়ে যেতে থাকে রাসূল সা. এর সাহাবিরা। যুদ্ধে কাফেরদের পরাজয় দেখে আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইরের নেতৃত্বে তারা আর স্থির থাকতে পারেন নি।

রাসূল সা. এর কঠোর নির্দেশ উপেক্ষা করেন তারা। নিজেদের অবস্থান ছেড়ে দেন। তীরন্দাজ বাহিনী গণিমতের মাল কুড়ানোর জন্য মাঠে নেমে যায়। তীরন্দাজ বাহিনী স্থান ত্যাগ করার পর বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে যুদ্ধের গতিপথ পাল্টে যায়। এই সুযোগটিকে কাফের নেতা খালিদ বিন ওয়ালিদ কাজে লাগায়। পিছন দিক থেকে আক্রমণ করে মুসলমানদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

এই যুদ্ধে মুসলমানদের ৭৩ জন মুজাহিদ শহীদ হন। এই যুদ্ধে রাসূল সা. এর দন্ত ভেঙ্গে যায়। কিন্তু গুজব ছড়িয়ে পড়ে তিনি নিহত হয়েছেন। সাহাবিরা নিজের বুককে ঢাল বানিয়ে নবীজিকে রক্ষার প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে থাকে। হামজার হত্যাকারী ইবনে কামিয়া রাসূল সা. কে তরবারি দ্বারা কঠিন আঘাত করলে নবীজির শিরস্ত্রাণ বিদীর্ণ হয়ে দুটি লৌহ কড়া তাঁর কপালে বিঁধে গেল।

রাসূর সা. অচেতন হয়ে পড়ে গেলেন। কুরাইশরা মুহম্মদ নিহত বলে উল্লাস করতে লাগল। শহীদ মুসআবের সঙ্গে চেহারায় মিল থাকায় এই গুজব আরো জোরালো হল। জ্ঞান ফিরলে নবীজি বললেন, ‘হে আমার প্রভূ ! আমার জাতিকে ক্ষমা করো, তারা অজ্ঞ, তারা বোঝে না’। হজরত আবু বকর রা. এবং ওমর ফারুক রা. এ যুদ্ধে রাসুল সা. এর সাথী ছিলেন।

পরে মুসলিম বাহিনী পিছু হটে ওহুদ পর্বতে আশ্রয় নিলেন।। মক্কার বাহিনী মক্কার দিকে ফিরে আসে। এই যুদ্ধে কুরাইশদের ৩৫০ জনের ও বেশি নিহত হয়। শুধু আবু সুফিয়ান, জুবাইর ইবনে মুতএম ও হাকেম ইবনে হিজাম ছাড়া তাদের নেতৃস্থানীয় প্রায় সবাই নিহত হয়। তারা তিনজনই পরে মুসলমান হয়েছিলেন। সন্ধ্যার আগেই নবীজি সবাইকে নিয়ে মদিনায় পৌছালেন।

তীব্র সম্মুখ যুদ্ধের পর অধিকাংশ মুসলিম ওহুদ পর্বতের ঢালে জমায়েত হতে সক্ষম হয়। মুহাম্মদ সা. ও পর্বতের উপরে আশ্রয় নেন। মক্কার সেনারা পর্বতের দিকে অগ্রসর হয়ে প্রতিরোধের ফলে আর অগ্রসর হয়নি। হিন্দ ও তার সঙ্গীরা মুসলিমদের লাশ টুকরা করে লাশের কান, নাক কেটে পায়ের গয়নার মত পরিধান করে। হিন্দ নিহত হামজার কলিজা বের করে চিবিয়েছিলেন।

ইতিমধ্যে তিনি সাআদকে কুরাইশদের গতিবিধি লক্ষ করার জন্য পাঠালেন। কুরাইশরা আল আতিক উপত্যকায় পৌছার পর আবার মদিনা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। এই সংবাদে নবীজি বিশিষ্ট সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শ করে আক্রমণ প্রতিহত করতে নতুন অভিযানে চললেন। কুরাইশরা মুসলমানদের পাল্টা অভিযানের খবর পেয়ে পিছু হটে মক্কার দিকে পালিয়ে যায়।

সাহাবাদের কাফেলা নিয়ে নবীজি মদিনার নিকটবর্তী হামরাউল আসাদ নামক স্থানে এসে উপস্থিত হলেন। কয়েকদিন সেখানে অবস্থান করে মদিনায় ফিরে আসেন। আর কুরাইশরা মদিনায় প্রবেশ না করেই ফিরে যান। এ যুদ্ধে কারোরই চুড়ান্ত বিজয় হয়নি। রাসূল সা. আহত মুজাহিদদের একত্রিত করে মর্মস্পর্শী এক ভাষণ দান করেন। সেখানে পুরুষদের পেছনে ১৪ জন মহিলা ও ছিলেন।

মুহাম্মদ সা. এর যুদ্ধ কৌশল


মুহাম্মদ সা. সেনাপতি হিসাবে যুদ্ধে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ওহুদকে যুদ্ধক্ষেত্র হিসাবে বেছে নেয়া ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। খোলা ময়দানে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত এবং ওহুদ পর্বতকে পিছনে রেখে যুদ্ধ করার ফলে পিছনের দিক থেকে মক্কা বাহিনীর আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত রাখা বড় ধরনের কৌশল। অশ্বারোহী বাহিনীর বিরুদ্ধে পদাতিক বাহিনীর কিভাবে লড়াই করা উচিত তার নমুনা এ যুদ্ধে দেখা যায়।

ইসলামের ইতিহাসে ওহুদের যুদ্ধ একটি শিক্ষণীয় ঘটনা। অসম এ যুদ্ধে মুসলিমরা প্রথমে বিজয় লাভ করলেও পরবর্তীতে পরাজিত হয়। পরাজয়ের পর আল্লাহ বাণী পাঠান- ‘মন ভাংগা হয়ো না, চিন্তা ক্লিষ্ট হয়ো না। তোমরাই বিজয়ী থাকবে যদি তোমরা সত্যিকার মুমিন হও।’ সবচেয়ে বড় শিক্ষা রাসূলের কথা অমান্য করা ও মতভেদ করা এবং ছত্রভঙ্গ হওয়ার মন্দ পরিনাম জানিয়ে দেয়া।

ওহুদ যুদ্ধ ছিল চরম পরীক্ষা ও মুসিবতের দিন। এ যুদ্ধের মাধ্যমে আল্লাহ মুমিনদের পরীক্ষা ও মুনাফিকদের ছাটাই বাছাই করেন। যারা মুখে ঈমানের দাবী করতো কিন্তু মনে মনে গোপনে কুফরী ধ্যান-ধারণা পোষণ করতো এই দিন তারা চিহ্নিত হয়ে যায়। আল্লাহ যে সব প্রিয় বান্দাকে শাহাদাতের সম্মানে ভূষিত করতে চান এ দিন তাদেরকে শাহাদাত দিয়ে সম্মানিত করেছেন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url